ডিজিটাল দুনিয়ায় নজরদারির অভাবে সন্তানের যেসব ক্ষতি হতে পারে

প্রযুক্তিনির্ভর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে মানুষের আচরণ-অভ্যাস। ডিজিটাল দুনিয়ার সহজলভ্য আকর্ষণ ফেসবুক-টুইটার। এরসব সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব পূর্ণবয়স্কদের পাশাপাশি স্কুলগামী শিশুদের মধ্যেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বেশি ব্যবহার করতে গিয়ে অনেকেই আত্মীয় স্বজন, বন্ধু-বান্ধব থেকেও দূরে সরে যাচ্ছেন। এতে টিন-এজারদের স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এমন অবস্থায় শিশুর মানসিক গঠন ও বিকাশ বিকাশের স্বার্থে ডিজিটাল দুনিয়ার অভিভাবকদের ‘সতর্ক নজর’ বাড়াতে হবে। না হলে শিশুরা বড় ধরনের ক্ষতির মুখোমুখি হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশেজ্ঞরা।
একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেসবুক আসক্তির ঝুঁকিতে আছে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, করোনার সময় অনলাইন ক্লাস ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতির ব্যবহার বেড়ে যাওয়া আসক্তির ঝুঁকিও বেড়েছে। এই আসক্তি থেকে বাঁচতে অভিভাবকদের ‘ডিজিটাল মিডিয়া লিটারেসি’ বাড়ানো প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞতরা মনে করেন, ডিজিটাল আসক্তির থেকে রক্ষার জন্য প্রান্তিক পর্যায়েও কাউন্সেলিং প্রয়োজন। আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক কাউন্সেলিং বা শিক্ষকরাও ক্লাসরুমে এই বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারেন। তবে সাইবার জগতে সন্তানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্যারেন্টাল কন্ট্রোলের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি বলেও তারা মনে করেন। তাদের মতে, সব ডিজিটাল মাধ্যমেই এই সুবিধা আছে। এর মাধ্যমে সন্তান কী কনটেন্ট দেখছে, তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন অভিভাবকরা।
গ্রিন ইউনিভার্সিটির জার্নালিকজম অ্যান্ড মিডিয়া কমিউনিকেশন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. শেখ শফিউল ইসলাম বলেন, ‘যারা অতিমাত্রায় সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে, তাদের মধ্যে একটা আসক্তি কাজ করে। এর ফলে তার পড়াশোনা, চিন্তা-চেতনা, শারীরিক ও মানসিক বিষয়সহ অনেক ক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অনেকের চোখে ব্যথা হয়, মাথাব্যথায় ভোগে। পাশাপাশি চিন্তাশক্তিও সীমাবদ্ধ হয়ে যায়।’
এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘কমবয়সী ছেলে-মেয়েরা অনেক সময় নেতিবাচক ও অশ্লীল কনটেন্ট দেখে। এজন্য অভিভাবকদের উচিত সন্তানের সঙ্গে চমৎকার বন্ধুত্বপূর্ণ বোঝাপড়ার সম্পর্ক তৈরি করা। সন্তানরা কী ওয়েবসাইট দেখছে, তা মনিটরিং করা। প্রয়োজনে সন্তানদের নিয়ে একসঙ্গে অভিভাবকরা সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করতে পারেন।’
হলুদের চাদরে স্বপ্ন বোনে কৃষকেরাহলুদের চাদরে স্বপ্ন বোনে কৃষকেরা
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা বলেন, ‘ডিজিটাল জগৎ একটা সমুদ্র। এখানে ভালো-খারাপ দুটোই আছে। ভার্চুয়াল লাইফ ও বাস্তব জীবনকে সমন্বয় করা নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কিছু বিষয় বলেছিল। এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল প্যারেন্টাল কন্ট্রোল। এটা হচ্ছে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ডিজিটাল জীবন কিভাবে মনিটর করবেন, তারই দিক-নির্দেশনা। ইউটিউব-গুগলে প্যারেন্টাল কন্ট্রোলের আলাদা আলাদা ফিচার আছে। এমনকি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সার্ভিসেও প্যারেন্টাল কন্ট্রোল স্থাপন করা যায়। অভিভাবকরা গুগল সার্চ করে নিজে নিজেই এই ব্যাপারগুলো শিখতে পারেন।’
তানভীর হাসান জোহা আরও বলেন, ‘এরপর আসে ডিজিটাল আসক্তির বিষয়। এ নিয়ে বাংলাদেশে অনেক কাউন্সেলর আছেন, যারা কাজ করছেন। আমরা অনেক সময়ই ভাবি, যে ব্যক্তি মানসিক কাউন্সেলিংয়ের জন্য যাচ্ছেন, তিনি পাগল। ব্যাপার কিন্তু তা নয়। আসক্তি কাটাতে কাউন্সেলিংয়ের জন্য বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নেওয়া প্রয়োজন।’
নিয়মিত হেডফোন ব্যবহার করছেন?নিয়মিত হেডফোন ব্যবহার করছেন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক তৌহিদুল হক বলেন, ‘তরুণরা সোশ্যাল মিডিয়া বেশি ব্যবহার করায় ভার্চুয়াল জগতের সঙ্গে বেশি যোগাযোগ অনুভব করে। বাস্তব জীবনে যতটা সময় বা মনোযোগ দেওয়া দরকার, তারা সেটা করতে পারছে না। অন্যান্য দেশের তরুণদের মধ্যেও আমরা এই বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই। আমাদের তরুণরা বুঝতে পারে না যে, কোন কনটেন্টটা তার উপযোগী, কোনটা উপযোগী নয়। এসব দেখার জন্য আমাদের দেশে সংস্থাও আছে। কিন্তু তাদের কাজ প্রত্যাশিত গতিতে এগোচ্ছে না।’
তৌহিদুল হক আরও বলেন, ‘সোশ্যাল মিডিয়া বোঝা বা এ বিষয়ে সন্তানকে শিক্ষা দেওয়ার সক্ষমতা সব অভিভাবকের সমান নয়। অভিভাবকরা যা করতে পারেন, সন্তানকে কনটেন্টের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা দিতে পারেন। সন্তান কোন কনটেন্ট উপভোগ করবে আর কোন কনটেন্ট এড়িয়ে যাবে, সেই শিক্ষাটা দিতে হবে। তরুণরা সবসময়ই সংক্ষিপ্ত পথে হাঁটতে চায়, বিভিন্ন বিষয়ের অভিজ্ঞতা নিতে চায়। এজন্য সন্তানের সঙ্গে অভিভাবকদের খোলামেলা আলোচনা দরকার।’
তরুণদের সামাজিকযোগাযোগ মাধ্যম বা গেমের আসক্তি কাটাতে অভিভাবকদের পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ভূমিকা রাখার পরামর্শ দিয়ে এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘শিক্ষকদের পরামর্শ আমাদের প্রয়োজন। এখানে আরেকটি বিষয়ের কথা বলতে হবে। সন্তান অনলাইনে আসক্ত হয়ে পড়লে অভিভাবকরা কোত্থেকে সহায়তা নেবেন, সেটা রাষ্ট্রকে ঠিক করতে হবে।’ একেবারে প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত সহায়তার ব্যবস্থা থাকা দরকার বলেও তিনি মনে করেন।