রফতানিতে একটি খাতের ওপর অতি নির্ভরতা ঝুঁকিপূর্ণ

 প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২১, ০২:০০ অপরাহ্ন   |   অর্থ ও বাণিজ্য




গত তিন দশক ধরে বাংলাদেশ তার বলিষ্ট প্রবৃদ্ধি নৈপুণ্যের কারণে আন্তর্জাতিক মহলে বিশেষভাবে প্রশংসিত। দারিদ্র্য প্রশমনে রেকর্ড এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জনসংখ্যাগত ফলাফলে সমসারির দেশগুলোর চেয়ে বেশ খানিকটা অগ্রগতি দেখিয়ে এরই মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। সাফল্য গাঁথার একটা বড় অংশ এসেছে শ্রমঘন ও রফতানিমুখী শিল্পায়ন থেকে। ২০০১ সালে বাংলাদেশের পণ্যদ্রব্য রফতানির মোট মূল্য ছিল ৬৬০ কোটি ডলার (৫৬ হাজার ১০০ কোটি টাকা)। ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৭২০ কোটি ডলার বা ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি।

বিষয়টি আরো পরিষ্কার করে দেওয়া যায়— ২০০১ সালে বিশ্বের রফতানিতে বাংলাদেশের অংশ ছিল ০.১ শতাংশ; কিন্তু ২০১৯ সালে সেটি দ্বিগুণেরও বেশি বেশি বেড়ে হয়ে যায় ০.২৫ শতাংশ। তৈরি পোশাক উৎপাদনে চূড়ান্ত মনোযোগ দেওয়ার ফলেই রফতানিতে সাফল্যের গল্পটা তৈরি হয়েছে। দেশের মোট রফতানিতে ২০০০ সালেই তৈরি পোশাকের হিস্যা ছিল যেখানে ৭৫ শতাংশ, তা ২০১৯ সালে এসে ৮৬ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশকে বলা যেতে পারে ‘দ্বিতীয় উন্নয়ন বিস্ময়’। এমনকি একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে দ্রুত বর্ধিষ্ণু তৈরি পোশাক রফতানিকারক দেশ ভিয়েতনামের ২০০০ সালের মোট রফতানিতে এ পণ্যের অবদান ছিল ১২.৭ শতাংশ, সেটি ২০১৯ সালে কমে দাঁড়ায় ১১.৩ শতাংশ।


বাংলাদেশ রফতানি আয়ে তৈরি পোশাক খাতের ওপর ক্রমান্বয়েই আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। তৈরি পোশাক-বহির্ভূত পণ্যসমূহের মন্থর প্রবৃদ্ধির জন্যে সরকারের পক্ষপাতিত্বমূলক নীতি দায়ী কি না এ প্রশ্ন আজ বেশ জোরেই উচ্চারিত হচ্ছে। পোশাকশিল্পের যে নাটকীয় প্রবৃদ্ধি, তার নানাবিধ কারণ রয়েছে। পোশাক উৎপাদকেরা উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি ও ব্যবসার বিস্তারের চেষ্টায় বলতে গেলে এক প্রকার আগ্রাসি ভূমিকা পালন করছে। সরকারের নীতি সহযোগিতাও শিল্পটির বিকাশে সাহায্য করে যাচ্ছে। এ খাতে আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপনের পর বিশেষত সোয়েটার বিভাগে মেশিন চালকেরা নানাবিধ আকর্ষণীয় পোশাক উৎপাদন করছে। অনেক উদ্যোক্তা এখন রফতানির জন্য ল্যাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার অনাবিষ্কৃত বাজারগুলোয় ছোটাছুটি করছে। এ শিল্পের আরো বিকাশে সহায়ক শক্তি হিসেবে সরকার তার সর্বোচ্চ সব নীতি দিয়ে সহযোগিতা যুগিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, রফতানিমুখী বাকি খাতগুলো দীর্ঘদিন ধরে সরকারের অবহেলার শিকার হচ্ছে। তাদের অভিযোগ, সরকারের সব মনোযোগ কেবল তৈরি পোশাক খাতের ওপর নিবদ্ধ এবং তাদেরই সব প্রকারের সাহায্য করে যাচ্ছে, যার ফলে তৈরি পোশাক-বহির্ভূত খাতগুলোর প্রবৃদ্ধির গতি এখন মন্থর কিংবা স্তব্ধ। তাদের অভিযোগ অবশ্য অমূলক নয়। উদাহরণস্বরূপ, পোশাক তৈরির কারখানাগুলোর বন্ড লাইসেন্স নবায়নের সময় তিন বছর হলেও চামড়ার কারখানাগুলোর বেলায় তা দুই বছর। এখানেই শেষ নয়, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক উত্পাদক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ তাদের অঙ্গীভূত যে কোনো কারখানার বেলায় সদ্ব্যবহার ঘোষণা (ইউটিলাইজেশান ডিক্লারেশান) জারি করতে পারলেও চামড়া উৎপাদকদের সংগঠন এমন ক্ষমতা রাখে না। এসবের পাশাপাশি রফতানি উন্নয়ন তহবিল, সবুজ তহবিল ও কম খরচের গৃহায়ণ কর্মসূচিরও দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকে তৈরি পোশাক খাতের ওপর।


বাংলাদেশের রফতানিযোগ্য পণ্যেও তালিকায় ৭৫০টি নাম রয়েছে। কিন্তু বার্ষিক রফতানি রশিদের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ আসে তৈরি পোশাক ও অন্যান্য কয়েকটি আইটেম থেকে। এই পরিস্থিতি বিবেচনায়, তৈরি পোশাক শিল্পের যথাযথ বিকাশের জন্য সরকারের সব ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা যে অত্যাবশ্যক, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যাকে দিয়ে লাভ বেশি, তাকেই তো যত্ন-আত্তিটা বেশি হবে, এটিই তো স্বাভাবিক। আরো পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে, তৈরি বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশের পোশাক খাতের প্রতিযোগিতামূলক তীব্রতা ধরে রাখার জন্য এর কোনো বিকল্প নাই। তবে এটি অস্বীকার করার জো নেই যে, রফতানির ক্ষেত্রে একটি খাতের ওপর অতি-নির্ভরতা খুব ঝুঁকিপূর্ণ। কোনো কারণে পেছলে পড়লে দেশের গোটা অর্থনীতিতে এর পরিণামটা হবে ভয়াবহ। এমন হলে অন্যান্য খাতগুলো যদি কমবেশি বিকশিত থাকে তখন বিপর্যয় কিঞ্চিত করে হলেও সামাল দেওয়ার একটা সম্ভাবনা থেকে যায়। অন্য খাতগুলোর ওপর ক্রমান্বয়ে হলেও মনোযোগ দেওয়ার খুবই গুরুতপূর্ণ সময় চলছে এখন। তৈরি পোশাকশিল্পের বাইরের খাতগুলোর প্রতি অবজ্ঞা কিছুতেই কাম্য নয়।

বিষেশষজ্ঞরা বলছেন, অবহেলিত খাতগুলোর উন্নয়নে সরকারে নেওয়া আগের পদক্ষেপগুলো ছিল হয় কৌশলগত অথবা প্রয়োগসংক্রান্ত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এ দুটির একটিও বাদবাকি পণ্যের বহুমুখীকরণ ও বাজার সম্প্রসারণের চেষ্টায় যথেষ্ট ছিল না। তৈরি পোশাকের বাইরের পণ্যগুলোর বাজার সম্প্রসারণ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে সরকারের নীতি-সহযোগিতা সরবরাহের বিকল্প খুঁজে নেওয়ার কাজটা বাইরে থেকে সহজ মনে হলেও আসলে কিন্তু খুব কঠিন। যারা ক্ষুদ্র সরবরাহকারী, তাদের প্রয়োজন হচ্ছে নেটওয়ার্কিং, ম্যাচ ম্যাকিং এবং তাদের পণ্যের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিশ্বব্যাপী তথ্যের আদান-প্রদান একেবারে জরুরি। এত সবের পরও আরেকটি না বললে অপূর্ণ থেকে যাবে। এক দেশের সরকারের সঙ্গে আরেক দেশের সরকারের আন্তর্জাতিক সমঝোতা শুল্ক প্রতিবন্ধকতাগুলো কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে টনিকস্বরূপ। তুলনামূলকভাবে নতুন বাজারগুলোয় সুযোগ রয়েছে পর্যাপ্ত। কিন্তু স্থানীয় ব্যবসায় সঠিক জ্ঞান ও প্রচেষ্টার ত্রুটি, স্থানীয় ব্যবসা ও সরকার সম্পর্কে জানার প্রচেষ্টার ঘাটতিতে অপ্রচলিত পণ্যের অনেক বাজারে কবে যে এমন দুরবস্থা কবে দূর হবে তা বলা মুশকিল। বাংলাদেশের প্রবেশাধিকার এখন পর্যন্ত অধরাই রয়ে গেছে। সম্ভাবনায় অনেক বাজারে বাংলাদেশের অপ্রচলিত আইটেমগুলো চাহিদা যথেষ্টই। বাংলাদেশের অপ্রচলিত বা প্রচলিত পণ্য—এ দুই খাতে ল্যাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার বাজারে ঢোকার প্রবেশাধিকার অর্জন করা এখন পর্যন্ত সম্ভব হয়নি। নতুন বাজার আবিষ্কারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কীর্তি এখন পর্যন্ত শিশুসুলভ। কিন্তু রফতানি জন্য নিত্যনতুন আইটেম নির্বাচন ও নতুন বাজারে প্রবেশের সুযোগ লাভ রফতানি বাজারে বিভিন্ন আইটেমের রফতানি বাংলাদেশের মোট রফতানি আয়ের ভারসাম্যহীনতা কমিয়ে অসাধারণ অবদান রাখতে পারে।