ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ কারখানা বন্ধ : সংকটে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানা

 প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২১, ১২:৪২ অপরাহ্ন   |   অর্থ ও বাণিজ্য


কঠোর লকডাউনের মধ্যে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রায় ২০ হাজারের বেশি কারখানা খোলা থাকলেও তারা পড়েছেন নানা দুশ্চিন্তায়। ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ পণ্য না পাওয়ার পাশাপাশি কর্মী আনা-নেয়ায় সমস্যা এবং ফ্রেইট (মালামাল পরিবহন) জটিলতায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। দেশের বেশিভাগ খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ছোট-মাঝারি পর্যায়ের। এমনকি অধিকাংশ বড় প্রতিষ্ঠানও কমপ্লায়েন্স নয়। ফলে তাদের পণ্য প্রক্রিয়াকরণের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নিতে হয়। সেসব সহযোগী প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। সে কারণে সম্পূর্ণরূপে পণ্য প্রস্তুত করে বাজারজাতকরণে সমস্যা হচ্ছে।

 কঠোর লকডাউনের মধ্যে সরকার খাদ্য ও খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের মিল কারখানা চালু রেখেছে। এ খাতেরই ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের (সহযোগী শিল্প) কারখানা বন্ধ থাকায় নানা সমস্যা হচ্ছে খাদ্য উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণে।  এভাবে কিছুদিন ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ কারখানা বন্ধ থাকলে আমাদের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ প্রসেসিং, প্যাকেজিং ম্যাটারিয়ালস ছাড়া কোনো পণ্যই রফতানি উপযোগী করা সম্ভব নয়। রফতানিও করা যাবে না ।
দেশে প্রচুর কৃষিপণ্য, দুধ, ডিম,মাংসসহ অন্যান্য খাদ্য নষ্ট হয়ে যাবে যথাযথ প্রক্রিয়াকরণ সম্ভব না হলে। এছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য উৎপাদন, বিপণন ও রফতানি ব্যাহত হলে ভোক্তার কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য পৌঁছানো সম্ভব হবে না। ফলে দেশে ভয়াবহ খাদ্য সঙ্কট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষক ও খামারিরা ব্যাপক লোকসানে পড়বেন।

ঈদের ছুটিতে যাওয়া অধিকাংশ শ্রমিক এখনো কাজে ফিরতে পারেননি। পাশাপাশি কন্টেইনারের বাড়তি ভাড়ার কারণে বিপর্যয়ে পড়েছে খাতটি। আগের তুলনায় এখন কন্টেইনার ভাড়া ১০ গুণ বেড়েছে। অনেক পণ্য এজন্য রফতানি করা যাচ্ছে না।

 গত বছর বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের যে ভয়াল থাবা অর্থনীতিতে আঘাত করেছে, তার ধাক্কা লেগেছে এই কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণশিল্পেও।দেশে করোনার প্রকোপ থাকলেও প্রধান রফতানিবাজার ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে করোনার প্রকোপ নেই। এমনকি ভারতেও করোনা কমে এসেছে। সবাই এখন তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে জোর দিচ্ছে। নতুন নতুন ক্রেতা এবং অর্ডার আসছে। এ সময় অল্প কিছুদিনের জন্য রফতানি থমকে গেলে তার প্রভাব হবে দীর্ঘমেয়াদি। মোড়কজাতকরণে সমস্যা হলে দেশের বাজারের চেয়ে বেশি সমস্যা হবে রফতানিতে। যারা রফতানি আদেশ পেয়েছেন তারা পণ্য দিতে পারবেন না। ফলে বিদেশি ক্রেতা হারানোর শঙ্কা তৈরি হবে।’ ছোট-বড় মিলিয়ে ১৯ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের সঙ্গে জড়িত। দেশের ২০ শতাংশ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ কাজে জড়িত। প্রক্রিয়াজাত কৃষিপণ্য খাত বাংলাদেশের জিডিপিতে ২ শতাংশেরও বেশি অবদান রাখছে। যদিও মহামারিকালেই দেশের কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের ইতিহাসে হয়েছে সর্বোচ্চ রফতানি আয়ের রেকর্ড। সদ্যসমাপ্ত অর্থবছরে (২০২০-২১) এ শিল্পের রফতানি আয় ১০০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক পার করেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে ১০২ কোটি ৮১ লাখ ডলারের পণ্য বাংলাদেশ থেকে বিদেশে রফতানি হয়েছে। আগের অর্থবছর যে অংক ছিল ৮৬ কোটি ডলারের কিছু বেশি।

 খাদ্য নিয়ে উন্নত বিশ্ব খুবই সচেতন। কোনো ধরনের ছাড় তারা দেয় না। তাই আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে মান রক্ষা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প গড়ে তুলতে সরকারের বিশেষ সহায়তাও প্রয়োজন। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে বাংলাদেশকে আলাদা অবস্থান করে নিতে হলে সক্ষমতা উন্নয়ন, প্রযুক্তি বিনিময়, উন্নত ব্যবস্থাপনা, তদারকি জোরদার করতে হবে। বিশ্বে খাদ্য সংকট দেখা দিলে বাংলাদেশ যেন প্রক্রিয়াজাত খাদ্য রফতানি করতে পারে, তার প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে হবে। নীতিমালা তৈরির সঙ্গে মান রক্ষায় তদারকি জোরদার করতে হবে। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণপূর্বক রফতানি আয় বাড়ানো এবং খাদ্যের অপচয় রোধের অংশ হিসেবে সরকার অ্যাগ্রো ফুড প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রি প্রমোশন পলিসি, ২০২০ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে। 
প্রয়োজন টেকসই ফসল উৎপাদন, মূল্য সংযোজনের মাধ্যমে কৃষকের আয় বৃদ্ধি, অতিরিক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন এবং জনগণের পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করা। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প দেশে বিনিয়োগ, প্রযুক্তি ও রফতানির ভিত্তিতে নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। লাগসই প্রযুক্তি ও উন্নয়ন সহায়তার মাধ্যমে কৃষিভিত্তিক শিল্প উন্নয়ন করতে হলে বহুমুখী প্রতিযোগিতার মোকাবেলা করতে হবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নতুন নতুন উদ্ভাবন ও বিকল্প প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের বহু ধরনের প্রক্রিয়াকরণ খাদ্যের উৎপাদন লক্ষণীয়। কেবল নতুন পণ্যের উন্নয়নই নয়, বরং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার, গুণগত মানের উন্নয়ন, বায়োসেপ্টি ও প্যাকেজিং ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং সেই সঙ্গে প্রক্রিয়াকরণ খাদ্যের বিপণন জোরদারের পাশাপাশি উৎপাদন পদ্ধতির ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। উন্নত যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, প্রাকৃতিক গ্যাসের সহজলভ্যতা ছাড়া ক্ষুদ্র, মাঝারি ও বৃহৎ কৃষিভিত্তিক শিল্পের উন্নয়ন সম্ভব নয়।