১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি কী, এটা কী প্রত্যাহার করা যায়?

ফৌজদারি কার্যবিধির চতুর্দশ অধ্যায়ে পুলিশের অপরাধ তদন্তের পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তদন্তকালে পুলিশ আসামি ও সাক্ষীকে পরীক্ষা করার ক্ষমতা রাখে।
তবে আসামি স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকারোক্তি দিতে রাজি হলে পুলিশ তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে উপস্থাপন করেন। ম্যাজিস্ট্রেট ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করেন। এই ধরনের জবানবন্দি সাক্ষ্য হিসেবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার পদ্ধতি, এটার সাক্ষ্যগত মূল্য এবং একবার ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দিলে তা কী প্রত্যাহার করা যায়, সে বিষয়ে আলোচনা করা হলো।
স্বীকারোক্তি কে কখন কখন লিপিবদ্ধ করতে পারবেন:
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ (১) ধারা অনুযায়ী মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট, প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট এবং এই বিষয়ে সরকার কর্তৃক বিশেষভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত দ্বিতীয় শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করতে পারবেন। এ ধরনের জবানবন্দি তদন্ত বা অনুসন্ধানকালে বা বিচার শুরু হওয়ার আগে বা পরে যেকোনো সময় করা যাবে। তবে লিপিবদ্ধকারী ম্যাজিস্ট্রেটের অপরাধ বিচারের এখতিয়ার এখানে বিবেচ্য হবে না।
স্বীকারোক্তি কত প্রকার:
ঘটনায় আসামির নিজের সম্পৃক্ত করে যখন স্বীকারোক্তি দেন তখন তাকে (ইনকাল্পাটরি কনফেশন) এবং নিজেকে অপরাধের সঙ্গে না জড়িয়ে স্বীকারোক্তি দিলে তাকে (এক্সইনকাল্পাটরি কনফেশন) বলা হয়। কার কাছে স্বীকারোক্তি দেওয়া হচ্ছে সেদিক বিবেচনা করলে-ম্যাজিস্ট্রেট বা বিচারকের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তিকে (জুডিসিয়াল কনফেশন) এবং ম্যাজিস্ট্রেট ব্যতীত অন্য কাউকে দেয়া স্বীকারোক্তিকে (এক্সইনকাল্পাটরি কনফেশন) বলা হয়।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার পদ্ধতি:
কোন আসামির ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেটের কিছু আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কার্যবিধির ১৬৪(৩) ধারায় বলা হয়েছে, জবানবন্দির পূর্বেই ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে জানাবেন যে, তিনি স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য নন এবং স্বীকারোক্তি দিলে তা তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার হতে পারে। স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছায় হচ্ছে বলে যুক্তিসংগতভাবে বিশ্বাস না করা পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেট তা লিপিবদ্ধ করবেন না। উপরোক্ত বিষয়গুলো পালন করা হয়েছে মর্মে একটি স্মারক মন্তব্য ম্যাজিস্ট্রেট উল্লেখ করবেন। অতঃপর সেই জবানবন্দি ঘটনা সম্পর্কে যিনি অনুসন্ধান করবেন বা বিচার করবেন তার কাছে পাঠাবেন।
ম্যাজিস্ট্রেটকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করার ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৬৪ ধারার নিয়ম অনুসরণ করতে হবে। এই ধারা অনুযায়ী আসামিকে জিজ্ঞাসিত প্রতিটি প্রশ্ন জবাবসহ সমগ্র জবানবন্দি আসামি যে ভাষায় বলবে বা আদালতের ভাষায় লিপিবদ্ধ করতে হবে। এরপর সেই জবানবন্দি ম্যাজিস্ট্রেট আসামিকে পড়ে শুনাবেন। জবানবন্দি আসামির বোধগম্য ভাষায় লিখিত না হলে সারমর্ম বুঝিয়ে দেবেন। জবানবন্দির সত্যতা স্বীকার করলে আসামি এবং ম্যাজিস্ট্রেট নিজে সেটাতে সই করবেন। এছাড়া উপরোক্ত বিষয় প্রতিপালন হয়েছে মর্মে ম্যাজিস্ট্রেট প্রত্যয়ন করবেন।
সাক্ষ্যগত মূল্য:
ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তির সাক্ষ্যগত মূল্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ হলে তার ওপর ভিত্তি করেই আসামিকে সাজা দেওয়া যাবে। ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনে জবানবন্দি গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা রয়েছে। এই আইনের ২৬ ধারা মোতাবেক পুলিশ হেফাজতে থাকাকালে কোন স্বীকারোক্তি দিলে উহা আসামির বিরুদ্ধে প্রমাণ করা যাবে না। তবে ম্যাজিস্ট্রেট দোষ স্বীকারোক্তি লিপিবদ্ধ করলে তা প্রাসঙ্গিক হবে। তবে এই আইনের ২৪ ধারা মোতাবেক প্রলোভন, ভীতি প্রদর্শন কিংবা প্রতিশ্রুতির দ্বারা স্বীকারোক্তি আদায় করা হলে তা প্রাসঙ্গিক হবে না। যদিও এই আইনের ২৯ ধারা অনুযায়ী অন্যভাবে প্রাসঙ্গিক হলে শুধু পদ্ধতিগত ত্রুটির জন্য তা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
সহ-আসামির স্বীকারোক্তি:
সাক্ষ্য আইনের ৩০ ধারা অনুযায়ী একসঙ্গে যৌথভাবে একাধিক ব্যক্তির বিচার হলে তাদের একজন নিজেকে ও অপর আসামিকে জড়িত করে স্বীকারোক্তি দিলে তা অপর আসামির ক্ষেত্রে বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে প্রতিষ্ঠিত নীতি হলো-পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্য দ্বারা প্রমাণিত না হলে শুধু সহ-আসামির স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে কাউকে সাজা দেওয়া যাবে না।
স্বীকারোক্তি কী প্রত্যাহার করা যায়: ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জবানবন্দি দেওয়ার পর তা যেকোনো সময় প্রত্যাহারের আবেদন করা যাবে। যখন মামলার নথিতে জবানবন্দি প্রত্যাহারের আবেদন থাকে তাকে বলা হয় প্রত্যাহারকৃত জাবনবন্দি (রেট্রাক্টেড কনফেশন)। আসামির নিজেকেই এ ধরনের আবেদন করতে হয়। পারিপার্শ্বিকভাবে প্রমাণিত হলে শুধু স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারের আবেদন করা হয়েছে এ কারণেই আসামি খালাস পেতে পারে না। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় সাফাই সাক্ষীর সময়ও স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারের আবেদন করা যায়। তবে প্রত্যাহারের আবেদন বিবেচনা করা না করা সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ার।